শফিকুর রহমানের ছাদবাগানের শুরুর কথাটা বেশি দিনের নয়। শুরুটা হয়েছিল মূলত করোনা মহামারিতে স্কুল বন্ধ থাকায় একমাত্র ছেলেকে মোবাইল এবং টেলিভিশনের আসক্তি থেকে রক্ষা করতে। তিনি তার দুইতলা বাড়ির ছাদে গড়ে তোলেন বাগান।
খুলনা মহানগরীর বসুপাড়া লেনের কেসিসি পরিচালিত ইসলামাবাদ কলেজিয়েট স্কুলের সামনের একটি সরু রাস্তার মাথায় দোতলা বাড়ি। নিচ থেকে দেখলে বোঝার উপায় নেই বাড়ির ছাদে প্রায় ২ হাজার গাছ রয়েছে। সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই চোখে পড়ে বিদেশি বিভিন্ন প্রজাতির কাছ টবে থরে থরে সাজানো। বারান্দায় ও ব্যালকনিতে রয়েছে লতাকৃতির গাছ। ছাদে উঠতেই চোখ জুড়িয়ে যায় সবুজের সমারোহে। লোহার তাকে টব ঝুলিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বিদেশি এসব গাছ। নাম দিয়েছেন আদুলিয়াদেজ এগ্রো এন্ড রুফ গার্ডেন।
ডা. শফিকুর রহমান জানান, ছাদে বর্তমানে প্রায় তিনশ প্রজাতির ২ হাজার গাছ রয়েছে। প্রতিটি গাছই টবে লাগানো। গাছগুলোতে মাটির পরিমাণও শতকরা ২৫ ভাগের বেশি নয়। অর্থাৎ তুষ, কাঠ কয়লা, ছাই, গাছের গুঁড়া, কোকোপিট, সরিষার খৈল, ভার্মি কম্পোস্ট দিয়ে লাগানো হয়েছে গাছগুলো। খুলনার বিভিন্ন নার্সারি, যশোর, ঢাকা, আশুলিয়া, ভারত, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন স্থান থেকে তিনি গাছগুলো সংগ্রহ করেছেন। দেশের মধ্যে যেখানেই দুর্লভ গাছের সন্ধান পেয়েছেন সেখানে তিনি গিয়েছেন। বিদেশি গাছ তিনি আমদানীকারকদের কাছ থেকেও সংগ্রহ করেছেন। বিগত দু’বছর ধরে তিনি গাছগুলো সংগ্রহ এবং রক্ষণাবেক্ষণ করলেও এখন পর্যন্ত তেমন বিক্রি করতে পারেননি।
সর্বোচ্চ ৪-৫ হাজার টাকার গাছ বিক্রি করেছেন জানিয়ে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, প্রয়োজনের অতিরিক্ত গাছগুলো কেবল বিক্রি করব। কোনো উদ্যোক্তা যদি এগুলো নিয়ে ব্যবসা করতে চান তাহলে তাকে সব ধরনের সহায়তা করা হবে। বিশেষ করে এক্ষেত্রে গাছগুলো রক্ষণাবেক্ষন থেকে শুরু করে যেকোনো পরামর্শ বিনা পারিশ্রমিকে দেবো।
তিনি বলেন, এখন পৃথিবীব্যাপী যেভাবে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে সেখানে এ ধরনের গাছের চাহিদা বাড়বেই। বাড়ির ব্যালকনি, ছাদে এমনকি পড়ার টেবিলেও কেউ যদি এর কোনো একটি গাছ টবে করে রাখতে চান তাও সম্ভব। এমনকি এভাবে অনেকে পড়ার টেবিলে গাছ রাখছেন।
শফিকুর রহমান বলেন, ছোটবেলা থেকেই গাছ লাগানোর শখ ছিল আমার। আসলে শহরের বাড়িতে জায়গা এবং কর্মব্যস্থতার কারণে ওইভাবে করা হয়নি। ছোটবেলার শখ আর ছেলেটাকে মোবাইল এবং টেলিভিশনের আসক্তি থেকে দূরে রাখতে গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করি। ১১-১২টি গাছ দিয়ে শুরু করে ছাদে আজ প্রায় ২ হাজার গাছ রয়েছে। এদিক-ওদিক ঘোরা-ফেরা না করে ছেলেটা এখন ২ হাজার গাছের যত্নে সময় ব্যয় করছে।
তিনি আরও বলেন, এখানে সবই বিদেশি প্রজাতির গাছ। হয়া, সাকুলেন্ট, পেপারোমিয়া, এডেনিয়াম, ফিটোনিয়া, ফার্ন, পাথোস, অর্কিড বিভিন্ন প্রজাতির গাছ দেশীয় পদ্ধতিতে চাষ করা হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের পাতাবাহার, সৌখিন ফুলের গাছ যেটা ভালো লেগেছে সংগ্রহ করেছি। ইন্টারনেট থেকে ছেলেকে ছবি দেখিয়েছি, তার ভালো লাগার গাছগুলোও সংগ্রহ করেছি। ছেলেটার ঘুম ভাঙার পর থেকে গাছের যত্ন ও লেখাপড়ার মধ্যে রাখতে আমার এই প্রয়াস। এতে আমার বাচ্চার চোখও ভালো থাকবে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়ে তিনি বলেন, ক্যালেন্ডার টাইপের গাছ আনার ইচ্ছা রয়েছে। যে গাছগুলো মানুষ শুধু ছবিতে দেখে, সেই গাছগুলোর ব্যাপক সমারোহ করা হবে। আধুনিক বহুতল ভবনের নাগরিক জীবনে এই গাছগুলা ফুল ও পাতার সৌন্দর্য দিয়ে বৃক্ষপ্রেমী তথা সকলের মনে প্রশান্তি আনবে। এসব গাছের ৯৫ শতাংশই ফুলের গাছ, বাকিগুলোতে পাতার সৌন্দর্য রয়েছে।
ডা. শফিক বলেন, যদি কেউ এখানে আসতে চায়, পরামর্শ চায় ফ্রিতে দেওয়া হবে। এখনও বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয়নি, তবে বাড়তি গাছগুলো যদি কেউ নিতে চায়, তাদের দেওয়া হবে। আমার এখানে ২০০ টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা মূল্যের গাছও রয়েছে।
শফিকের ছেলে খুলনার সেন্ট জোসেফ স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র আদুলিয়াদিজুর রহমান ওরফে মোমিন বলেন, আগে মোবাইল দেখতাম। তবে গাছ আনার পর থেকে গাছের প্রতি আমার ঝোঁক আসে। ঘুম থেকে উঠার পর থেকে ৬-৭টা পর্যন্ত গাছের যত্নে সময় দেই। এরপর পড়তে যায়। লেখাপড়ার পাশাপাশি গাছের যত্ন নিয়ে মনটা ভালো থাকে এবং গাছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও বাড়ে।
খুলনার একটি এনজিও কর্মী মনিরুল ইসলাম বাবু বলেন, গাছ আমার খুবই পছন্দের। মাঝে মাঝে এখানে গাছ দেখতে আসি। প্রকৃতিকে বাঁচানোর জন্য আমাদের বেশি বেশি গাছ লাগানো উচিত। জায়গা নেই তবুও যে গাছ লাগানো যায় তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এই ছাদবাগান। বৃক্ষের মধ্যে থাকলে মন, পরিবেশও ভালো থাকে এবং আমরা অক্সিজেন পাই।
স্থানীয় ব্যবসায়ী রকিবুল আলম সজিব বলেন, ডা. শফিক ও তার ছেলের এই উদ্যোগটা খুবই ভালো লাগে। আমি মাঝে মাঝে আসি এখানে। আমার পার্টনার, বন্ধুরাও এখানে আসে। ছেলেকে আটকানোর পাশাপাশি গাছ লাগানোর সুন্দর একটি উদ্যোগ আসলেই প্রশংসার দাবিদার। খুলনার বুকে এত সুন্দর ছাদবাগান আমার জানামতে আর কোথাও নেই।
ঢাকা/মীম
0 মন্তব্যসমূহ