খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্যবসায়ী মহসিন খান ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন বন্ধুবৎসল। দিনের বেশিরভাগ সময় আনন্দে থাকতেই পছন্দ করতেন তিনি। তার মতো প্রাণবন্ত মানুষের আ ত্মহ ত্যার ঘটনায় অবাক আত্নীয়স্বজন ও নিকটজনেরা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজে ময়নাতদন্ত শেষে বৃহস্পতিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে লাশ আনা হয় ধানমন্ডির বাসায়। বাসার গ্যারেজে লাশবাহী ফ্রিজার গাড়ির পাশে কোরআন তেলাওয়াত করা হচ্ছিল দুপুরের পর থেকে। সেখানেই দাড়িয়ে ছিলেন মহসিন খানের মেয়ে জামাই চিত্রনায়ক রিয়াজ। কিন্তু, তিনি কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলেন না। হাতের মোবাইল দিয়ে লাশবাহী ফ্রিজার ভ্যানের ছবি তুলছিলেন।
কে জানে এই ছবিই হয়তো পৌছে যাচ্ছিল, গাড়ির ভেতরে চিরনিদ্রায় শুয়ে থাকা মহসিনের খানের ছেলে ও স্ত্রীর কাছে- যারা আছেন সুদূর অস্ট্রেলিয়ায়। প্রাণহীন মহসিন খানের একাকী অন্তীম যাত্রায় আসতে পারছেন না তারা।
অবশ্য একা ছিলেন অনেকদিনই। বুধবার মারা যাওয়ার আগে প্রায় ১৫ মিনিটের ফেসবুক লাইভে মহসিন খান বলেছেন বিস্তারিত। বন্ধুবৎসল এই মানুষটি একাই এক ফ্লাটে ছিলেন চার বছর। তার আগে বছর কয়েক ছিলেন অস্ট্রেলিয়ায়। একমাত্র ছেলে আফ্রিদি খান নিশানের পড়াশোনার সূত্রেই সেখানে থাকা।
মহসিন খানরা ছিলেন তিন ভাই। তিনিই সবার বড়। তার ছোট ভাই আরিফ খান ও লিপু খান।
বৃহস্পতিবার দুপুরের পরে ভাইয়ের লাশের গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলেন ছোট ভাই- লিপু খান। বলেন, ‘আমার ভাই ছিলেন পারিবারিকভাবে হিরো। আমাদের শৈশবে তাকে সবাই অনুসরণ করতো। তার জন্ম কুমিল্লায়, তারপর ১৯৮০ সালের দিকে আমাদের পুরো পরিবার ঢাকায় চলে আসে। সবাই মিলে থাকতাম ঢাকার গ্রিনরোডে। সেখান থাকার সময়েই বড় দুই ভাই বিয়ে করেন। পরিবার বড় হয়। আস্তে ধীরে আলাদা হয়ে যায় সবাই। তবে যেকোনো ঈদে বা উৎসবে সবাই এক হতাম। হৈ-হুল্লোড় করতাম। এগুলোর উৎস ছিলেন বড় ভাই- মহসিন খান।’
মহসিন খানের বাবা আবু তাহের ব্যবসায়ী ছিলেন। তার পথ ধরে তিন সন্তানও ব্যবসায়ী। বাবা বেঁচে আছেন। মা নেই। বাবা থাকেন তার ছোট ভাই লিপু খানের সাথে।
লিপু খান জানান, তার ভাই যে ব্যবসায়ীক ভাবে এত ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছেন- সেটা তারা জানতেন না। জানলে তারা নিজেরা ব্যবস্থা নিতেন।
তিনি বলেন, ‘একটা সময় আমার ভাই ব্যবসায়ীকভাবে খুব সফল ছিলেন। তার সঙ্গে সবসময় গানম্যান থাকতো। যখন রাস্তায় বের হতেন তিন-চারটা গাড়ির বহর নিয়ে বের হতেন। তার চলাফেরাই ছিলে হিরোর মতো। মারা যাওয়ার তিনদিন আগেও আমি আর ভাইয়া একসঙ্গে ডিসি অফিসে গিয়ে পিস্তলের লাইসেন্স রিনিউ করে এসেছি। কখনো কি ভেবেছি, সেই পিস্তল দিয়েই ভাই নিজেকে হ ত্যা করবেন।’
মহসিন খান খুব ঘুরতে পছন্দ করতেন। সুযোগ পেলেই দেশে ও দেশের বাইরে বেড়াতে যেতেন। গত দুই বছরের করোনায় সেই সুযোগটাও কমে এসেছিল। তবুও কিছুদিন আগে জামাই রিয়াজ, মেয়ে টিনা ও নাতনির সঙ্গে ঘুরে এসেছেন।
সেই ঘটনা উল্লেখ করে লিপু খান বলেন, ‘ভাইয়া একা থাকেন বলেন তার বাসায় খুব বেশি যাওয়া হতো না। তবে দেখা হতো প্রায়দিনই। আমরা বাইরে দেখা করতাম, গল্প করতাম। বাসার সঙ্গে একটু অভিমান ছিল। কারণ আমাদের সব সম্পত্তি ব্যাংকের কাছে মর্টগেজ দেয়া। সেখান থেকে ভাইয়া তার সস্পত্তি বুঝে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেটা তো কখনোই সম্ভব না। তাছাড়া বাবার শরীরও ভালো না। বড় সন্তানের এমন মৃত্যুর খবর শুনে তিনি নির্বাক হয়ে গেছেন। কোনো কথাই বলেন নাই।’
মহসিন খানের মরদেহের পাশ থেকে একটি সুইসাইড নোট পাওয়া গেছে। যেখানে লেখা রয়েছে, ‘ব্যবসায় ধস নেমে যাওয়ায় আমি হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। আমার সঙ্গে অনেকের লেনদেন ছিল। কিন্তু তারা টাকা দেয়নি। আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।’
তবে ফেসবুক লাইভে নিজের শারীরিক অবস্থা, পরিবারের সদস্য ছাড়াও নিজের একাকিত্ব, ব্যবসায় লোকসান, কাছের মানুষের প্রতারণা শিকার হয়েছেন বলে উল্লেখ করেছিলেন মহসিন খান।
কথা শেষ করার আগে আগে লিপু বলেন, ‘ভাইয়ার বাসায় রান্না হতো না। তিনি বাইরে খেতেন, ফুডপান্ডায় অর্ডার করে খাবার আনাতেন অথবা আমার বাসা থেকে আসতো। তিনি গরুর সিনার মাংস খেতে পছন্দ করতেন। কয়েকদিন আগে বড় একটা বক্সে রান্না করা সিনার মাংস দিয়ে গেছি। পুরোটা শেষ করতে পারেননি। এখনও সেটা ফ্রিজে আছে’- বলতে বলতেই কেঁদে ফেলেন লিপু খান।
ভবনের কেয়ারটেকার মো. গোলাম রাব্বী বলেন, মহসিন খান ওই বাসায় একা থাকতেন। তার বাসায় কোনো কাজের বুয়া বা ড্রাইভার ছিল না। একাই রান্নাবান্না করে একাই থাকতেন। আবার অনেকসময় বাইরে থেকে খাবার আনাতেন। তার একটা প্রাইভেটকার আছে। সেটা এখন তিনি নিজেই ড্রাইভ করতেন।
ঢাকা/মীম
0 মন্তব্যসমূহ