তিনি স্বপ্নে চাকরি পাচ্ছেন, সেটি আগেই জানা গিয়েছিল। তবে কোন পদে যোগ দিচ্ছেন, সে বিষয়টি জানা গেল তার যোগদানের পরেই।
এর আগে দুপুর ১২টার দিকে আলমগীর কবির বগুড়া জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে যান। সেখানে আলমগীরের সঙ্গে প্রায় ২ ঘণ্টা কথা বলেন এসপি সুদীপ কুমার। পরে সন্ধ্যার দিকে পুলিশ প্লাজা শপিংমলের ‘স্বপ্নের’ বগুড়া শাখায় রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট পদে তাকে চাকরি ব্যবস্থা করেন এসপি।
দুপুরে তিনি বলেন, ‘আলমগীরের ওই বিজ্ঞাপনের সত্যতা যাচাই করার জন্য তার সাক্ষাৎকার নিই। কথা বলে মনে হয়েছে তার চাকরি আসলেই প্রয়োজন আছে। ‘আবার এটাও ঠিক, ওই ধরনের বিজ্ঞাপন দেয়া হীন মানসিকতার পরিচয়। সে কথা তাকে বলেছি।‘
কিন্তু কেন আলমগীর এমন বিজ্ঞাপন দিতে বাধ্য হলেন, তিনি কি সত্যিই নিরুপায় ছিলেন এবং তার পারিবারিক অবস্থা কেমন— এসব বিষয়ে কথা বলেছেন গণমাধ্যমের সঙ্গে।
আলমগীর বলেন, ‘বগুড়া শহরের কলেজে পড়ানোর মতো আর্থিক অবস্থা আমার পরিবারের ছিল না। কিন্তু আমার খুব ইচ্ছা ছিল শহরের কলেজে ভর্তি হব। মা-বাবা তাতে রাজি না হওয়ায় একদিন রাগ করে বাড়ি থেকে পালিয়ে বগুড়া শহরে আসি। হাত খরচের সব টাকা দিয়ে সরকারি আজিজুল হক কলেজে ভর্তি হই। পরিচিত এক বড় ভাইয়ের মেসে থাকা শুরু করি। তিনিই একটি টিউশনির ব্যবস্থা করে দিলেন। প্রতি মাসে ৭০০ টাকা পেতাম। সেটি খাওয়া বাবদ চলে যেত।’
জানা যায়, স্নাতক প্রথম বর্ষের পরীক্ষায় বিভাগে সর্বোচ্চ নম্বর পান আলমগীর। এ সময় তার দুরাবস্থার খবর জেনে যান এক শিক্ষক। পরে তাকে ওই শিক্ষক নিজের বাসায় রাখলেন। কিন্তু সেই শিক্ষক বছর তিনেক পর বগুড়া ছাড়লে পুনরায় বিপদে পড়েন আলমগীর।
আলমগীর বলেন, ‘ওই সময় বাধ্য হয়েই আমাকে মেসে উঠতে হয়। তখন টিউশনি করে দেড় হাজার টাকা পেতাম। তবে তার পুরোটাই খাবার খরচে চলে যেত। মেস ভাড়ার জন্য অন্যের কাছে হাত পাততে হতো। এক পর্যায়ে একটি বাড়ির কেয়ারটেকারের (বাড়ির মালিক ঢাকায় অবস্থন করেন) দায়িত্ব পেয়ে যাই। এর পর পড়াশোনা শেষে চাকরির জন্য চেষ্টা করতে থাকি।’
সরকারি-বেসরকারি বিজ্ঞপ্তি দেখলেই আবেদন করতেন তিনি। কিন্তু চাকরি নামের ‘সোনার হরিণের’ দেখা তিনি পাননি। তিনি বলেন, ২০১৯ সালে টিউশনির টাকায় সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের ৩৬টি পদে চাকরির আবেদন করি। সরকারি- বেসরকারি স্কুল-কলেজের নিবন্ধন পরীক্ষাতে উত্তীর্ণও হই। কিন্তু ভাইভাতে আমি বাদ পড়ে যাই।
করোনাভাইরাস তার কষ্টকে আরও বাড়িয়েছে উল্লেখ করে আলমগীর বলেন, দুই বছর আগে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে সবকিছু পাল্টে যেতে শুরু করে। বন্ধ হয়ে যায় টিউশনি। এর পর চাকরি পাওয়ার আশায় ঢাকায় যাই। সেখানে এক বন্ধুর মেসে থেকে চাকরি খুঁজতে শুরু করি। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত কোনো চাকরি না মেলায় বাধ্য হয়ে মাসে ৮ হাজার টাকা বেতনে কাজ নিতে হয় পোশাক কারখানায়। তবে সেখানে রাতের শিফটে ডিউটি দেওয়ায় চাকরির জন্য যেসব পরীক্ষা দিতে হতো তার জন্য প্রস্তুতি নিতে পারতাম না। তাই সে চাকরি ছেড়ে বগুড়া শহরে ফিরে আসি।
‘আগে যে বাসায় কেয়ারটেরকার ছিলাম সেখানেই থাকা শুরু করি। এর পর শহরের নূরানী মোড়ে একটি বাড়িতে রাতের খাবারের বিনিময়ে একটি টিউশনির ব্যবস্থা হয়। কিন্তু সকাল ও দুপুরের জন্য খাবারের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় বাধ্য হয়েই ২১ জানুয়ারি ‘দু-বেলা ভাতের বিনিময়ে পড়াতে চাই’ লেখা বিজ্ঞাপনটি আমি যে এলাকায় থাকি তার আশপাশের কয়েকটি বৈদ্যুতিক খুঁটিতে লাগিয়ে দিই। যা পরে ফেসবুকের মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়।’
জানা যায়, আলমগীরের বাবা ৮০ বছর বয়সি কফিল উদ্দিন পেশায় হোমিও চিকিৎসক। ছোট্ট একটি হোমিও দোকান ছিল তার। দোকান থেকে আয়ের অর্থ দিয়েই তাদের সংসার চলতো। তবে নানা শারীরিক জটিলতা দেখা দিলে চিকিৎসার খরচ জোগাতে দোকানটি বিক্রি করে দিতে হয়।
এর আগে মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে দুই বিঘা জমি বিক্রি করতে হয়েছিল কফিল উদ্দিনকে। এখন তার দুই বিঘা জমি থাকলেও চিকিৎসার খরচ যোগাতে এক বিঘা জমি বন্ধক রাখতে হয়েছে। তার বড় মেয়ে সেলাইয়ের কাজ করে সামান্য যে আয় করেন তা দিয়েই সংসার চলছে।
আলমগীরের মা আম্বিয়া বেগম বলেন, ‘আমার আলমগীর ছোট বেলা থেকে কষ্ট করছে। সে গরুর দুধ বিক্রির টাকায় পড়াশোনা করত। এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণের সামর্থ্য ছিল না। পরে কানের দুল বিক্রি করে টাকা দিতে হয়েছিল।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাদা কাগজে কালো কালিতে প্রিন্ট করা বিজ্ঞাপনটিতে আলমগীর নিজের নাম মো. আলমগীর কবির লিখলেও তার প্রকৃত নাম মো. আলমগীর হোসেন। তার বাড়ি জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি উপজেলার মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের বুড়ইল গ্রামে। শৈশব থেকে অভাবের সঙ্গে লড়াই করা আলমগীর ২০০৭ সালে পাঁচবিবি উপজেলার সরাইল উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ ৪.৫০ পাওয়া আলমগীর স্থানীয় কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশের পর উচ্চ শিক্ষার জন্য বগুড়ায় আসেন এবং সরকারি আজিজুল হক কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। পড়ালেখার জন্য কলেজের পাশেই একটি মেসে ওঠেন। পরে আজিজুল হক কলেজ থেকেই তিনি ২০১৩ সালে অনার্স ও ২০১৪ সালে মাস্টার্স করেন।
ঢাকা/মীম
0 মন্তব্যসমূহ