মানুষের নৈতিক উন্নয়ন ও দৈহিক শৃঙ্খলা বিধান, পারস্পরিক সম্প্রীতি-সহানুভূতি এবং সামাজিক সাম্য ও উন্নয়নের ক্ষেত্রেও রোজার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ
চলছে সারাবিশ্বের মুসলমানদের পবিত্রতম মাস রমজান। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে রোজা অন্যতম। এটি ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ ও অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইবাদত। আত্মসংযম, আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্মশুদ্ধিতা, ধৈর্য ও তাকওয়া অর্জনের অন্যতম প্রধান উপায় রোজা। এ ইবাদতের মাধ্যমেই মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা সম্ভব হয়। আল্লাহভীতি বা তাকওয়া অর্জন এবং আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনেও রোজা অপরিহার্য ইবাদত।
মানুষের নৈতিক উন্নয়ন ও দৈহিক শৃঙ্খলা বিধান, পারস্পরিক সম্প্রীতি-সহানুভূতি এবং সামাজিক সাম্য ও উন্নয়নের ক্ষেত্রেও রোজার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সাওম আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা, কঠোর সাধনা, আত্মসংযম ইত্যাদি।
সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল ধরণের পানাহার যৌনাচার ও যাবতীয় ইন্দ্রিয় তৃপ্তি থেকে বিরত থাকার কঠোর সাধনাকে সাওম বা রোজা বলা হয়।
রমজান মাসে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ-সবল জ্ঞানসম্পন্ন মুসলিম নর-নারীর ওপর রোজা রাখা ফরজ। অবশ্য রোজা পালনে অক্ষম, অসুস্থ, মুসাফির বা পর্যটক ব্যক্তিদের পরবর্তীকালে রোজা পালনের সুযোগ দিয়েছে ইসলাম।
আল কোরআনের ভাষায়, “তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি রমজান মাসে উপস্থিত হয় সে যেন রোজা রাখে। আর যে ব্যক্তি অসুস্থ হয় অথবা সফরে থাকে সে যেন পরবর্তী দিনগুলোতে তা আদায় করে” (বাকারা-১৮৬)।
মহানবী হযরত মুহাম্মা (সাঃ) রমজান মাসের রোজাকে ফরজ আখ্যায়িত করে বলেছেন, “তোমাদের নিকট তাকওয়ার মাস রমজানের আগমন হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা তোমাদের ওপর এ মাসের রোজাকে ফরজ করে দিয়েছেন”' (নাসাঈ, আহমদ, তিরমিজি, ইবনে মাজা)।
আত্মসংযম ও আধ্যাত্মিক উন্নতিতে রোজার গুরুত্ব এত ব্যাপক যে প্রত্যেক নবী-রাসূলের অনুসারীদের ওপর তা অপরিহার্য ছিল। আল কোরআনের ভাষায়, “তোমাদের ওপর রমজানের রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে তোমরা খোদাভীতি অর্জন করতে পারো”, (বাকারা-১৮৪)।
রোজা শুধু আবশ্যকীয় ইবাদতই নয়; বরং আত্মিক উন্নতি ও নৈতিক উৎকর্ষ সাধনেও এর ভূমিকা ব্যাপক। কাম-ক্রোধ, লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ ইত্যাদি মানবিক কুপ্রবৃত্তি থেকে দূরে রাখে রোজা। শয়তানের প্ররোচনা ও নফসের কুমন্ত্রণা থেকে আত্মাকে হেফাজত রাখতেও রোজার ভূমিকা অগ্রগণ্য।
সিয়ামের কঠোর শৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণ রোজাদারকে প্রকৃত মুসলিম হওয়ার সুযোগ করে দেয়। মুসলমানরা রোজার মাধ্যমেই মহান আল্লাহর সঙ্গে গভীর ও নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে। রোজার মাধ্যমেই মানবহৃদয়ে তাকওয়া বা আল্লাহভীতি সৃষ্টি হয়।
রোজাদার ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর হয়েও শুধু মহান আল্লাহর ভয়ে পানাহার ও অন্যান্য বর্জনীয় বিষয় থেকে বিরত থাকে। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ভালোবাসা লাভের আশায় ইন্দ্রিয় স্বাদ-তৃপ্তি থেকে বিরত থাকেন রোজাদার। তাকওয়া অর্জন ও তাকওয়াভিত্তিক জীবন গঠনই সিয়াম সাধনার প্রধান উদ্দেশ্য।
ধৈর্যশীলতা মানবজীবনের অপরিহার্য গুণ। ধৈর্য্যের মাধ্যমে জীবনের যেকোনো বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে কাঙ্খিত লক্ষে পৌঁছানো সম্ভব। সত্যন্যায়ের পথে চলতে হলে ধৈর্য ও ত্যাগের প্রয়োজন। জীবন সংগ্রামে টিকে থাকতে হলে সবর অপরিহার্য। মহান আল্লাহর আদেশ-নিষেধগুলো যথাযথভাবে পালন করতেও ধৈর্য্যের প্রয়োজন হয়। মূলত ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রসহ মানবজীবনের সামগ্রিক ক্ষেত্রে ধৈর্য বা সবরের বিশেষ প্রয়োজন। আর রমজান মাসের সিয়াম সাধনার মাধ্যমে সারা দিন প্রচণ্ড ক্ষুধা-তৃষ্ণা সত্ত্বেও পানাহার বর্জন করে রাতে দীর্ঘ সময় তারাবির নামাজ আদায় এবং ভোররাতে সেহরি গ্রহণ ইত্যাদির মাধ্যমে রোজাদারের ধৈর্য্যের প্রশিক্ষণ হয়। যারা এ প্রশিক্ষণে কামিয়াব হন তাদের জন্য রয়েছে পরম কাঙ্খিত জান্নাত।
রমজানের সিয়াম সাধনা এক অনন্য ধর্মীয় ও নৈতিক অনুশীলন। সিয়াম বলতে শুধু পানাহার থেকে বিরত থাকা বোঝায় না বরং অন্যায়-অসত্য, পরনিন্দা-অশ্লীলতা ইত্যাদি পাপাচার থেকে আত্মাকে কলুষমুক্ত করা বোঝায়। রোজার পুণ্য ও লক্ষ্য অর্জনের জন্য পানাহার বর্জনের সাথে পাপাচার-অশ্লীলতা বর্জনও শর্ত। অন্যথায় রোজার মূল উদ্দেশ্যে সাধনই ব্যর্থ।
আত্মিক ও নৈতিক উন্নতির পাশাপাশি দৈহিক উন্নতিতেও রোজার ভূমিকা লক্ষণীয়। দীর্ঘসময় পানাহার বর্জনে পরিপাকতন্ত্র সতেজ হয় বলে চিকিৎসকদের অভিমত।
পারস্পরিক সহানুভূতি-সহমর্মিতা ও সামাজিক সম্প্রীতি-ভ্রাতৃত্ববোধসহ মানবিক গুণাবলি প্রতিষ্ঠিত করতে রোজার ভূমিকা অনন্য। ভোগবিলাসে অভ্যস্ত মানুষরা রোজার মাধ্যমে ক্ষুধা-তৃষ্ণার ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পারে। এতে দরিদ্র মানুষের প্রতি বিত্তশালীদের সহানুভূতি-সহমর্মিতাবোধ জাগ্রত হয় এবং সমাজে সাম্য-মৈত্রীর পরিবেশ গঠন করতে সহায়তা করে।
রোজা মুসলিম সমাজে পবিত্র-পুণ্যময় পরিবেশ সৃষ্টি করে। রোজার মাধ্যমে মানুষ ধাবিত হয় পুণ্যের দিকে এবং দূরে থাকার সুযোগ পায় অন্যায়-পাপাচার থেকে। কঠোর সংযম সাধনা-সৎচিন্তায় রোজাদারের মন পাপ-পঙ্কিলমুক্ত হয়ে পবিত্র হয়ে ওঠে। তাই রোজার মাসে সমাজের সর্বত্র সৌম্য-শান্ত পবিত্রতা বিরাজ করে।
0 মন্তব্যসমূহ