নিবন্ধন ছাড়া অনলাইনে ব্যবসা করলে ১ বছরের জেল (কারাদণ্ড) বা ৫ লাখ টাকা জরিমানা দিতে হবে। এছাড়া অনলাইনে পণ্যের মিথ্যা তথ্য দিলে ৩ বছরের জেল বা ৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। একইসঙ্গে অনুমতি ছাড়া ওয়ালেট বা ক্যাশ ভাউচার তৈরি করলে ৬ মাসের জেল বা দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হবে।
এসব বিধান রেখে ডিজিটাল বাণিজ্য আইন-২০২৩ এর খসড়া তৈরি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে খসড়ার ওপর মতামত দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একশ্রেণির অর্থলোভী ব্যবসায়ীর অপকর্মের কারণে সম্ভাবনা সত্ত্বেও ডিজিটাল কমার্স খাতের বিকাশ হচ্ছে না। ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ শপ, সিরাজগঞ্জ শপ ডটকম, ধামাকা শপিং বা শ্রেষ্ঠ ডটকমের মতো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের প্রতারণা ও জালিয়াতির কারণে ডিজিটাল মাধ্যমে কেনাকাটায় ভোক্তারা আস্থা হারাচ্ছেন।
তাই ডিজিটাল কমার্স খাতে শৃঙ্খলা আনতে, গ্রাহকের স্বার্থ সুরক্ষা এবং ডিজিটাল বাণিজ্যে সংঘটিত অপরাধ শনাক্ত, প্রতিরোধ, দমন ও অপরাধের বিচার করতে আইনটি প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
ইতোমধ্যেই জাতীয় ডিজিটাল কমার্স নীতিমালার আওতায় ই-কমার্স বা এফ-কমার্স উদ্যোগকে নিবন্ধন নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত এক হাজার উদ্যোক্তা নিবন্ধন নিয়েছেন।
খসড়া আইনে বলা হয়েছে, ডিজিটাল মার্কেট প্লেসে (ওয়েবসাইট বা ফেসবুজ পেজ) ব্যবসা করতে নিবন্ধন নিতে হবে। এরপর নিবন্ধন সম্পর্কিত তথ্য ই-কমার্স বা এফ-কমার্সের নিজ ওয়েবসাইট বা পেজে প্রদর্শন করতে হবে।
এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে ব্যবসা করলে এক বছরের জেল খাটতে বা ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। মার্কেট প্লেসে পণ্য বা সেবার বিবরণ, আকার, পরিমাণ সঠিকভাবে উল্লেখ করতে হবে।
কোনো মিথ্যা তথ্য দিলে ৩ বছরের জেল বা ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য বা সেবা সরবরাহ না করলে পণ্য বা সেবার মূল্যের ৩ গুণ অর্থদণ্ড বা সর্বোচ্চ ৩ মাসের কারাদণ্ড হবে।
এছাড়া ডিজিটাল মার্কেট প্লেসে নিষিদ্ধ পণ্য বা সেবার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলে, অনলাইনে জুয়া বা বেটিংয়ের আয়োজন করলে ৩ বছরের কারাদণ্ড বা ৩ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেওয়া হবে।
যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া লটারির আয়োজন করলে, ডিজিটাল ওয়ালেট বা ক্যাশ ভাউচার তৈরি করলে ৬ মাসের জেল বা দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। ডাক বিভাগের অধীনে মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস আইনের অধীনে নিবন্ধন ছাড়া অন্য কোনো সংস্থা বা উদ্যোগের মাধ্যমে পণ্য পরিবহণ করলে ৬ মাসের কারাদণ্ড বা ২ বছরের জেল হবে। পরিবহণ খরচ ছাড়া গ্রাহকের কাছ থেকে বাড়তি অর্থ আদায় করলে এ জরিমানা দ্বিগুণ হবে। তবে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পণ্য গ্রাহকের কাছে পৌঁছাতে পারবেন উদ্যোক্তারা।
অবশ্য অনলাইন মার্কেট প্লেসের উদ্যোক্তারা বলছেন, শুধু নিয়ন্ত্রণ-মনিটরিং নয়, ই-কমার্স খাতের বিকাশের রোডম্যাপও থাকা দরকার আইনে। নইলে এ খাতের উন্নয়ন সম্ভব নয়।
ফেসবুক পেজে জামদানি শাড়ির ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘দ্যহ্যাঙ্গারসুইইনস্টাইল (thehangersewinstyle.com) এর মালিক অনলাইন উদ্যোক্তা মারজিয়া জলিল সুরভী বলেন, সরকার ডিজিটাল মার্কেট প্লেসকে একটি কাঠামোর মধ্যে আনতে আইন করতে চাচ্ছে, এটা নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ।
কারণ কতিপয় ভুঁইফোড় উদ্যোক্তা গ্রাহকদের নিুমানের পণ্য সরবরাহ করে অন্য ভালো উদ্যোক্তাদের বদনাম করে দিচ্ছে। একটি আইনি কাঠামো থাকলে এ ধরনের মানুষ ঠকানোর প্রবণতা বন্ধ হবে।
তবে নিবন্ধনের যে বিধান আইনে রাখা হয়েছে, তা অবশ্যই হয়রানিমুক্ত ও সহজ হতে হবে। যাতে অনলাইন উদ্যোক্তারা ঘরে বসেই নিবন্ধন করতে পারেন। এজন্য সরকারি কোনো অফিস বা কারও কাছে ধরনা দিতে না হয়।
তিনি আরও বলেন, ভালো উদ্যোক্তাদের প্রণোদনার ব্যবস্থা রাখা দরকার ছিল আইনে। ব্যাংক ঋণ, ট্যাক্স-ভ্যাট ছাড়ের বিষয়গুলোও উল্লেখ থাকলে ভালো হতো। খসড়া আইনে উল্লেখ করা হয়, এ আইনের অধীনে ডিজিটাল বাণিজ্য কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে, যার প্রধান হবেন একজন মহাপরিচালক।
এই কর্তৃপক্ষ অনলাইনে নকল পণ্য, মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর খাদ্য সংরক্ষণ বা নকল ওষুধ বাজারজাত করা হচ্ছে কিনা, তা তদারকি করবে। এছাড়া অসত্য বিজ্ঞাপন প্রচারের মাধ্যমে মানুষকে ঠকানো হচ্ছে কিনা তাও মনিটরিং করবে।
পাশাপাশি ডিজিটাল কমার্সের প্রসারে দক্ষ জনবল তৈরিতে প্রশিক্ষণ, ওয়ার্কশপ ও সেমিনারের আয়োজন করবে। আইন প্রণয়নের ৪ মাসের মধ্যে সব মার্কেট প্লেসকে নিবন্ধন নিতে হবে।
নিবন্ধন ছাড়া ডিজিটাল বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কোনো ব্যাংক, মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান বা পেমেন্ট গেটওয়ে কোম্পানি লেনদেনের চুক্তি করতে পারবে না। গ্রাহকের সুবিধার্থে ডিজিটাল মার্কেট প্লেসে পণ্য বা সেবার মান, উৎপাদনের তারিখ, মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ, প্রস্তুতকারক, প্রস্তুতের স্থান, মূল্যসহ সব বিষয় উল্লেখ করতে হবে। বিদেশি পণ্য হলে আমদানিকারকের বিবরণ উল্লেখ করতে হবে। নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রে একই দ্রব্য সর্বোচ্চ ৫টি এবং শৌখিন দ্রব্যের ক্ষেত্রে ২টির বেশি বিক্রি করা যাবে না। তবে পণ্যের মূল্যমান এক হাজার টাকার কম হলে ৫টি বিক্রি করা যাবে।
পণ্যের মূল্য পরিশোধ ও অভিযোগ দায়ের : খসড়ায় বলা হয়, পণ্যের মূল্য গ্রাহক তার সুবিধামতো ক্যাশ অন ডেলিভারি বা অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করতে পারবে। বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ডিজিটাল ফান্ড ট্রান্সফার, মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিসের মাধ্যমে পরিশোধ করা যাবে। গ্রাহকের অর্থ কোনোভাবেই ডিজিটাল মার্কেট প্লেসের পণ্য বিক্রেতার নিজস্ব ব্যাংক হিসাবে জমা দিতে পারবে না।
পণ্য ও সেবার মান পছন্দ না হলে গ্রাহকের অর্থ ফেরত দিতে হবে। গ্রাহকরা প্রতারিত হলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ জানাতে পারবেন। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর উভয়পক্ষের শুনানির মাধ্যমে অভিযোগ নিষ্পত্তি করবে এবং ৭২ ঘণ্টার মধ্যে অভিযোগ নিষ্পত্তিপূর্বক গ্রাহককে জানাবে।
এ বিষয়ে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সহসভাপতি শাহাবুদ্দিন শিপন বলেন, বাংলাদেশের ই-কমার্স খাত এখনো অনেক ছোট। ছোট ছোট প্রচেষ্টায় প্রসার লাভ করতে শুরু করেছে।
এ অবস্থায় আইনটি হওয়া উচিত ছিল ই-কমার্সের প্রসারে। কিন্তু খসড়া আইনে শুধু ত্রুটি-বিচ্যুতি বা অপরাধের সাজা, আর সাজার কথা বলা হয়েছে। এ খাতের বিকাশে বিদ্যমান প্রতিবন্ধতা বা সমস্যাগুলো উল্লেখ করা হয়নি।
অথচ আইনে থাকা উচিত ছিল, অনলাইনে উদ্যোক্তারা কীভাবে ঝামেলাহীনভাবে ব্যাংক ঋণ পেতে পারে বা অল্প সময়ে নিবন্ধন নিতে পারে তার নির্দেশনা থাকা। এছাড়া আলাদা কর ছাড় সুবিধা, অর্থনৈতিক অঞ্চলে জমি দিয়ে ছোট উদ্যোক্তাদের বড় উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ দেওয়া।
0 মন্তব্যসমূহ