সর্বশেষ খবর

10/recent/ticker-posts

নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কি কি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।।BDNews.in


 সাম্যের গান গাই-

আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!

বিশ্বে যা-কিছু মহান্‌ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,

অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।

-কাজী নজরুল ইসলাম (সাম্যবাদী)


যদি ঠিক আমাদের প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর কথা ধরেই মেনে নেই যে এই পৃথিবীকে সুন্দর ও কল্যাণকর করতে নারী এবং পুরুষের সমান অবদান রয়েছে। তাহলে আমাদের নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে এত আলাদাভাবে ভাবতে হচ্ছে কেনো? আমরা কি পুরুষদের নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে কখনো এভাবে ভেবেছি? সমাজের গুটিকতক মানুষ এর জন্য নারীরা ভীত হয়ে কেনো থাকবে? নারীরা যদি এই সমাজের অর্ধেক কাজে নিজেদের যোগদান দিয়ে থাকেন, তাহলে কি এই দেশ, জাতি আর সমাজের দায়িত্ব না নারীদের সেই একই অধিকার প্রদান করা যেনো তারা নিজেদের দায়িত্বগুলো নির্ভয়ে পালন করতে পারে।

কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের হলেও সত্যি যে, যখন নিরাপত্তার কথা আসে এই একুশ শতকে এসেও বলতে হয়, ঠিক আর কতটা দিন অপেক্ষা করলে নারীরাও মাথা উঁচু করে নির্ভয়ে চলতে পারবে। আমি জানি যদি দিতেই হয় তাহলে হাজারো উদাহরণ আছে স্ট্রং পার্সোনালিটির নারীদের। কিন্তু আপনি আর আমি কি তার মধ্যে পড়ি? আপনার কাছে একটা কোয়েশ্চন ছুড়ে দিলাম।

আমার ধারণা মতে এবং অভিজ্ঞতা আমাকে যেটা শিখিয়েছে সেই পেক্ষাপট থেকে আজকের বিষয়গুলো তুলে ধরবো। ক্ষেত্র বিশেষে আপনার সাথে অমিল চোখে পড়তেই পারে।

একটা মেয়ে তার শৈশব থেকে বৃদ্ধা হবার সময় পর্যন্ত জীবনের অনেকগুলো অধ্যায় পাড়ি দিয়ে আসে। এই পুরো সময়টা জুড়ে নানা উত্থান পতন এর উপর দিয়ে তাদের যেতে হয়।

একদম যদি ছোটবেলার কথা বলি মেয়ে শিশুরা বেশিরভাগ সময় নিরাপদ থাকেন তাদের পরিবারে। তাহলে প্রথম যে দায়িত্ব টা সেটা আসে তার ফ্যামিলির উপর যে কিভাবে তারা তাদের মেয়ে শিশুটিকে নিরাপদে রাখবে। আপনি হয়তো শুনে থাকবেন যে এই পুরো বিশ্বে মেয়ে শিশুরাও নানাভাবে ধর্ষণ বা নানা টর্চার এর শিকার হচ্ছে। এবং পরিসংখ্যান বলছে এই পুরো শিশু নির্যাতন এর বেশিরভাগ হয়ে থাকে তার পরিবারের আপন আত্মীয়স্বজন দ্বারা। যেটা কিনা আসলেই অকল্পনীয় যে আমাদের মেয়ে শিশুরা তাদের নিজেদের বাসায় নিরাপদ না।

তাহলে বাসায় মেয়েদের নিরাপত্তার ব্যাপার যখন আসে তখন প্রথমই যেটা খেয়াল রাখা উচিত যে আপনার বাসায় কারা কারা আছেন তাদের আচরণ বিধি কেমন। এবং বাহির থেকে খুব সহজেই কারা কারা আপনার বাসায় আসতে পারছে এবং তাদের স্বভাব চরিত্র কেমন। কারন আপনার যখন নিজের অভিজ্ঞতা হয়ে যাবে যে এই ব্যাক্তিটি ঠিক কেমন আপনি নিশ্চয় বুঝবেন আপনার মেয়ে শিশুটিকে আপনি কার সাথে মিশতে দিবেন আর কার সাথে দিবেন না। আমি বলবো এই দায়িত্বটা একটা পরিবারের সবারই। এবং আপনার চোখে যদি কখনো কারো আচরণ খারাপ মনে হয় সেক্ষেত্রে চুপ না থেকে ঘরের বাকি সদস্যদের এই ব্যাপারে অবগত করা উচিত, তা সে আপনার যত আপনই হোক না কেনো।

দ্বিতীয়ত, বাবা মার আরো একটা গুরু দায়িত্ব হলো তার সন্তানদের সাথে অনেক বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্ক গড়ে তোলা যাতে করে তার সন্তানের যেকোনো সমস্যার কথা সে সহজে তার বাবা মার কাছে বলতে পারে। কারন আপনার নিশ্চয় অজানা নেই যে, স্কুল-কলেজেও নানাভাবে আমাদের মেয়ে শিশুরা শারীরিক নির্যাতনের এর শিকার হচ্ছে।

আপনার সন্তান দের সাথে কমউনিকেশন যত স্ট্রং করবেন আপনার সন্তানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ততটা সহজ হবে। আর সর্বোপরি অবশ্যই চারপাশে ভালো মন্দের জ্ঞান থাকাটা জরুরী। 

আমি আমার কিছু ফিমেইল ফ্রেন্ড দের দেখেছি যারা তাদের সাথে ঘটে যাওয়া কোনো অন্যায় এর প্রতিবাদ করতে পারে না। অফিসে যখন একজন ফিমেইল ইমপ্লোয়ি প্রোমোশন পায়, ভালো পজিশন পায়, তখন তাকে বাহবার নামে নানা কুরুচিপূর্ণ ইংগিত করা হয়। আর এসব তারা সহজে কারো কাছে বলেও না। কারণ তারা ভয় পায় মানুষ কি বলবে, সমাজ কিভাবে নিবে। একটা ধর্ষণ হলে আঙুল দিয়ে দোষ দেখিয়ে দেয়া হয় মেয়েটার উপর। আমরা যদি এভাবেই সমাজের দেয়া অপবাদ এর ভয়ে চুপ হয়েই থাকি, তাহলে কি কখনো পরিবর্তন হবে এই সমাজের? আমাদের তো সামনে থেকে এসে এই অন্যায় এর প্রতিবাদ করতে হবে। দেশে আইন অনুযায়ী যে সাজা পাওয়া উচিত ওই ধর্ষকের সেই সাজা নিশ্চিত করতে হবে ধৈর্যের সাথে। এক দুইটা উদাহরণ সেট করতে পারলে তবেই না পরিবর্তন হবে এই সমাজের চেহারার। তবেই তো আমরা নিশ্চিত করতে পারবো আমাদের নিরাপত্তার।

এখান উপরোক্ত কাজগুলো করার জন্য যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো নারীদের নিজের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা, এবং যে কোনো সিচুয়েশন এর সম্মুখীন হওয়া সাহসিকতার সাথে এবং তার মোকাবিলা করা। আমরা নানা জায়গায় অবস্থান করতে পারি, সবসময় সবার পক্ষে বলাও সম্ভব নয় যে আমাদের চারপাশের মানুষগুলো ঠিক কেমন হবে, তাই নিজের সেইফটির জন্য কিছু বেসিক সেল্ফ ডিফেন্স ট্রিক জেনে রাখা ভালো। যেমন Adam’s Apple, Groin। এবং তার সাথে আরো জেনে রাখা ভালো কোন সেন্সেটিভ অংশগুলোয় এট্যাক করলে সহজেই আক্রমণকারীকে কুপোকাত করা সম্ভব। হ্যান্ডব্যাগ এ সহজেই ক্যারি করা যায় সেরকম পেপার স্প্রে, বালি বা মরিচের গুড়ো রাখতে পারেন। এগুলো কিছুক্ষণ এর জন্য হলেও সামনের মানুষটিকে বিভ্রান্ত করতে পারবে আর আপনি পালিয়ে যেতে সমর্থ হবেন।

এই ২০২০ সালেও যেখানে এক ভয়াবহ পেন্ডামিক এর কারনে হাজারো মানুষ মারা যাচ্ছে প্রতিনিয়ত, এই সময় টাতেও কিছু মানবতাহীন অসুস্থ চরিত্রের মানুষ ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধ করে যাচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে ধর্ষণের পরিমাণ ২০২০ সালে বেড়ে দাড়িয়েছে ১১,৬৮২টি। তাই সচেতনতা বৃদ্ধি করা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। যার জন্য আমরা আমাদের সমাজ, দেশ এবং সরকারের উপরই নির্ভরশীল। আর এই নির্ভরতা বজায় রাখতেই বাংলাদেশ সরকার ধর্ষণ আইনে পরিবর্তন এনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড প্রণয়ন করবার নির্দেশ দিয়েছেন।

আমি জানি হয়তো এরকম অসংখ্য সর্তকতামূলক পদক্ষেপ নেয়ার পর ও নারীদের উপর অত্যাচারটা কোনোভাবেই কমছে না এই সমাজে। আমার মনেহয় তার জন্য দায়ী আমরা নিজেরাই। কারন যখন আমার গায়ে হাত তোলা হয় আমার শ্বশুরবাড়িতে,  আমার স্বামী যখন আমার গায়ে হাত তোলে তখন আমরা প্রতিবাদ করিনা। আমরা ভাবি সংসার ভেঙে যাবে, লোকে নানা কথা বলবে। কিন্তু তার চেয়েও কি নিজেদের আত্মসম্মানটা বড় না? তার চেয়ে কি নিজেকে ভালোবেসে অস্তিত্বের লড়াইটা বড় না?

তাই সমাজের যেখানেই দেখছেন অন্যায় হচ্ছে কোনো নারীর উপর, চুপ থাকবেন না। বরং এগিয়ে আসুন। আপনি আজ একা আগাবেন, কাল আপনাকে সাপোর্ট করার জন্য আরো অনেকেই আপনার পাশে এসে দাঁড়াবে।

সর্বোপরি মানুষের মূল্যবোধ আর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের চেষ্টা শুরু করুন নিজ পরিবার থেকে। আমরা যখন আমাদের পরিবার থেকে দায়িত্ব নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করবো তখন ই একটা পরিবার থেকে গোটা সমাজ আর পরিশেষে গোটা দেশে সেই পরিবর্তন পরিলক্ষিত হবে।


নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে উপরোক্ত সবগুলো পয়েন্টস নিচে আরো একবার তুলে ধরলাম:

১.আপনার শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শিশুকাল থেকেই তাদের সাথে বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্ক গড়ে তুলুন।

২.আপনার বাসগৃহে কারা অবস্থান করছেন অথবা সহজেই যারা আপনাদের বাসায় আসতে পারছে তাদের আচরণবিধি কেমন তার দিকে নরজদারী রাখুন।

৩.আপনার শিশুর আচরনে কোনো পরিবর্তন দেখলে অবশ্যই তা অগ্রাহ্য না করে বরং তার মূল কারন খুঁজে বের করুন।

৪.যেকোনো জায়গাতেই ঘরে অথবা বাহিরে আপনার সাথে অন্যায় কিছু হলে তার প্রতিবাদ করুন।

৫.বাসে,স্কুল,কলেজে,রাস্তায় যেখানেই কেউ আপনাকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করছে বা বাজে ইংগিত দিচ্ছে তার বিরুদ্ধে রুখে দাড়ান।  

৬.নিজের যোগ্যতা এবং ব্যক্তিত্ব প্রকাশে করতে কখনোই পিছবা হবেন না।কারন আপনার কাজ ই আপনার সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ।

৭.আপনি যেকোনো বয়সেরই হোন না কেনো নিজের আত্মসম্মান এর জন্য লড়ে যান।

৮.রাস্তাঘাট বা যেকোনো জায়গায় নিজের সুরক্ষার জন্য বেসিক সেল্ফ ডিফেন্স ট্রিক অবশ্যই জেনে রাখুন।এবং সাথে কিছু সেল্ফ ডিফেন্স কিট ক্যারি করুন।

পরিশেষে এতটুকুই বলতে চাই, আমরা নারী আর আমাদের দ্বারাই বিকাশ এই প্রজন্মের। এই লড়াই আমাদের। আমাদের অস্তিত্বের আর স্বত্তার। নিজেকে ভালোবাসুন আর আত্মনির্ভরশীল হতে শিখুন। নিজের নিরাপত্তা নিজেই নিশ্চিত করুন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ