গত সোমবার (৮ জুলাই) সিআইডির হাতে গ্রেপ্তার হন পিএসসির ঊর্ধ্বতন তিন কর্মকর্তাসহ ১৭ জন। এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদে উঠে আসছে নানা তথ্য।
সিআইডিসূত্রে জানা গেছে, প্রথমে পরীক্ষার্থী সংগ্রহ করে তাদের সঙ্গে চুক্তি করা হতো। সেই চুক্তি অনুযায়ী ভাগে ভাগে নেওয়া হতো টাকা। প্রার্থীদের কাছ থেকে শুরুতে প্রিলিমিনারি পরীক্ষার আগে এক থেকে দুই লাখ টাকা নেওয়া হতো। পরে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার আগে আরও এক থেকে দুই লাখ। টাকার মূল অংশটা নেওয়া হতো নিয়োগ চূড়ান্ত হয়ে গেলে।
জানা গেছে, বিসিএসের জন্য প্রার্থীভেদে চুক্তি হতো ৪৫ থেকে ৫০ লাখ টাকায়। সব সরকারি চাকরি ক্ষেত্রে টাকার অংকটা ১৮ থেকে ২০ লাখ টাকা।
প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে বেশ সতর্ক ছিল চক্রটি। হোয়াটসঅ্যাপ বা ম্যাসেঞ্জার নয়, পরীক্ষার আগের রাতে চুক্তিবদ্ধ পরীক্ষার্থীদের নিজের গোপন আস্তানায় নিয়ে আসতেন তারা। সিআইডি বলছে, প্রশ্নপত্র ফাঁস করে বাকিদের হাতে তুলে দিতেন পিএসসির উপ-পরিচালক মো. আবু জাফর ও মো. জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক মো. আলমগীর কবির। চক্রের বাকি সদস্যরা কেউ চাকরিপ্রার্থী সংগ্রহ করতেন, কেউ প্রশ্নপত্র পেয়ে তা সমাধান করতেন, কেউবা চাকরি প্রার্থীদের ঢাকায় এনে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি টাকার অংক নির্ধারণ করতেন।
প্রার্থী খোঁজার কাজ ছিল পিএসসির অফিস সহায়ক খলিলুর রহমান ও অফিস সহায়ক (ডিসপাস) সাজেদুল ইসলামের। পরীক্ষার্থীদের বাসায় এনে উত্তরপত্রও পড়াতেন তারা। আর পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যানের গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী টাকা লেনদেন ও প্রশ্নফাঁসের বুথ পরিচালনা করতেন। এভাবে লুটে নিতেন কোটি কোটি টাকা। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তদন্তে অনেক হাইপ্রোফাইলের নামও উঠে এসেছে।
এছাড়া এই প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে বিজি প্রেসকেন্দ্রিক একটি দল জড়িত বলে ধারণা করা হচ্ছে। চক্রের সদস্যদের হোয়াটসঅ্যাপ কথোপকথন থেকে প্রশ্ন ফাঁস সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্যও মিলেছে বলে জানিয়েছে সিআইডির একটি সূত্র। এছাড়া মিলেছে বেশ কিছু ডিজিটাল আলামত। তাদের কাছ থেকে দুটি বিসিএস পরীক্ষার শত শত প্রবেশপত্রের ফটোকপি পাওয়া গেছে। তবে কোন দুটি বিসিএস পরীক্ষার প্রবেশপত্র সে বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি।
এর আগে, গত রোববার বিসিএসসহ পিএসসির অধীনে অনুষ্ঠিত ৩০ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এরপর বিপিএসসির তিন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী।
গ্রেপ্তারের পর রাজধানীর পল্টন থানায় বিপিএসসি আইনে মামলাটি দায়ের করেন সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের সাইবার ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অপারেশনস বিভাগের উপ-পুলিশ পরিদর্শক (এসআই) নিপ্পন চন্দ্র চন্দ। মামলায় ৩১ জনের নামোল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আরও ৫০ থেকে ৬০ জনকে আসামি করা হয়। তাদের মধ্যে গ্রেপ্তার ১৭ জনকে গত মঙ্গলবার আদালতে হাজির করা হয়।
মামলার এক নম্বর আসামি সৈয়দ আবেদ আলী (৫২)। তিনি দীর্ঘদিন পিএসসির সাবেক সদস্য মাহফুজুর রহমানের গাড়িচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। দুই নম্বর আসামি নোমান সিদ্দিক (৪৪)। লক্ষ্মীপুরের রামগতি এলাকার বাসিন্দা গার্মেন্টস (পোশাক) ব্যবসায়ী নোমান থাকতেন মিরপুর-১০ সেনপাড়া পর্বতা এলাকায়।
তিন নম্বর আসামি খলিলুর রহমান (৩৮)। চার নম্বর আসামি মো. সাজেদুল ইসলাম (৪১)। পাঁচ নম্বর আসামি মিরপুর ইসিবি চত্বরের ডেভেলপার ব্যবসায়ী আবু সোলেমান মো. সোহেল (৩৫)। ছয় নম্বর আসামি পিএসসির উপ-পরিচালক (সিলেট) জাহাঙ্গীর আলম (৫৮)। সাত নম্বর আসামি পিএসসির সহকারী পরিচালক এসএম আলমগীর কবীর (৪৯)। আট নম্বর আসামি গাজীপুর সেনানিবাসের অডিটর প্রিয়নাথ রায় (৫১)। নয় নম্বর আসামি মিরপুরের জাহিদুল ইসলাম (২৭)। দশ নম্বর আসামি পিএসসির উপ-পরিচালক মো. আবু জাফর (৫৭)।
বাকি আসামিরা হলেন নারায়ণগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসের নিরাপত্তা প্রহরী শাহাদাত হোসেন, ঢাকার ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অফিসে কর্মরত মো. মামুনুর রশীদ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মেডিকেল টেকনিশিয়ান মো. নিয়ামুল হাসান, ব্যবসায়ী সহোদর সাখাওয়াত হোসেন ও সায়েম হোসেন এবং একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র লিটন সরকার ও সৈয়দ আবেদ আলীর ছেলে ছাত্রলীগ নেতা সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম।
এখনো পলাতক রয়েছে, পিএসসির সাবেক সহকারী পরিচালক নিখিল চন্দ্র রায়, শরীফুল ইসলাম ভূঁইয়া, দীপক বনিক, খোরশেদ আলম খোকন, কাজী মো. সুমন, এ কে এম গোলাম পারভেজ, মেহেদী হাসান খান, গোলাম হামিদুর রহমান, মুহা. মিজানুর রহমান, আতিকুল ইসলাম, এটিএম মোস্তফা, মাহফুজ কালু, আসলাম ও কৌশিক দেবনাথ।
0 মন্তব্যসমূহ