সর্বশেষ খবর

10/recent/ticker-posts

চাকুরীর বাজারে পুরুষের চেয়ে নারীরা পিছিয়ে যে কারণে।।BDNews.in


বিডি নিউজ ডেস্কঃ অতীতে বাঙ্গালি সমাজে নারীদের শিক্ষা গ্রহণের হার অনেক কম থাকলেও বর্তমানে তা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গেছে । বাংলাদেশে গত পাঁচ বছর থেকে প্রতি বারের মতো এবারও ২০২৪ সালের ১২ মে এসএসসি (সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেট)  ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল   প্রকাশের পর দেখা যায় পাশের হার ও জিপিএ ফাইভে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা এগিয়ে রয়েছে । এবারের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে মোট পাশের হার ৮৩.০৪ শতাংশ হলেও ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের পাশের হার প্রায় ৩ শতাংশ বেশি । ছেলেদের পাশের হার ৮১.৫৭ শতাংশ এবং মেয়েদের পাসের হার ৮৪.৪৭ শতাংশ!

আবার ২০২৩ সালের এইচএসসি (হাইয়ার সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেট) পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এইচএসসিতেও মেয়েদের পাসের হার ছেলেদের চেয়ে বেশি । ছেলেদের পাসের  হার ৭৬.৭৬ শতাংশ হলেও মেয়েদের পাসের হার কিন্তু ৮০.৫৭ শতাংশ ।  এসএসসি এবং এইচএসসির মতো উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও মেয়েরা বেশ এগিয়ে । বাঙ্গালি সমাজে উচ্চশিক্ষায় মেয়েদের উপস্থিতি খুব একটা কম না ।  উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও দেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েমেয়েরা বেশ এগিয়ে যাচ্ছে । বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্র ও ছাত্রীর পার্থক্য ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়সহ মেডিকেলে অ্যাকাডেমিক পরীক্ষায়ও অনেক ক্ষেত্রে ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে আছে মেয়েরা! 

বাঙ্গালি সমাজে পারিবারিকভাবে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা কম সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার পরও  তাদের তুলনায় কীভাবে পড়াশুনায় এগিয়ে যাচ্ছে? যেখানে বাঙ্গালি কুসংস্কারের ভিত্তিতে ধরেই নেয়া হয় যে মেয়েদের বুদ্ধি কম! সেখানে ক্রমাগত অ্যাকাডেমিক পরীক্ষায় ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের ভাল সাফল্য সত্যিই একটা বিস্ময়কর ব্যাপার । দৈনিক যুগান্তরের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী এ বিষয়ে বলেন, “ধারাবাহিকভাবে পড়াশোনায় মেয়েরা এগিয়ে থাকার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। তা হলো-মেয়েরা পড়াশোনায় অনেক সিরিয়াস। বেশির ভাগ পরিবার মেয়েদের বাইরে ঘোরাফেরা, আড্ডা দেওয়া পছন্দ করে না। বাড়িতেই বেশি সময় কাটাতে হয়। ফলে তারা সেই সময় কাজে লাগায়। লেখাপড়া করে...।”

তবে শিক্ষাজীবনে বিভিন্ন পরীক্ষায় নারীরা এগিয়ে থাকলেও চাকুরীতে নিয়োগের বিভিন্ন পরীক্ষা যেমন বিসিএস, পিএসসি এর অধীনে পরীক্ষা এবং সরকারী ও বেসরকারি ব্যাংকসহ নানা  পরীক্ষায় নারীরা ততোটা এগিয়ে থাকে না । বিসিএস (বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস) পরীক্ষার মাধ্যমে সরকারি চাকরীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে ।  গত পাঁচ বিসিএসে সুপারিশপ্রাপ্তদের পরিসংখ্যান নিলে দেখা যাবে নারীদের নিয়োগের হার ছিল এক-চতুর্থাংশ অর্থাৎ ২৫-২৬ শতাংশ । সর্বশেষ ৪৩ তম বিসিএসে নারীর সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার হার নেমে এসেছে ২০ শতাংশেরও নিচে। গত ৬টি সাধারণ বিসিএসের গড় হিসাব করলে  দেখা যায় যে প্রতি ১০০ ক্যাডার পদের বিপরীতে ৭৫ টিতেই নিয়োগ পেয়েছে পুরুষ । আর নারীদের ক্যাডার পদে নিয়োগের হার মাত্র ২৫ শতাংশ! অথচ দেশের উচ্চশিক্ষায় ছাত্র ও ছাত্রীদের সংখ্যা প্রায় সমান। অ্যাকাডেমিক বিভিন্ন পরীক্ষার ফলাফলেও এগিয়ে মেয়েরাই। এমন প্রেক্ষাপটে উচ্চশিক্ষা শেষে নারীদের চাকরির ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ার কারণ অনুসন্ধান করা একটা সময়ের দাবী । 

অ্যাকাডেমিক পরীক্ষায় মেয়েদের পাশের হার ছেলেদের তুলনায় বেশি বা সমান থাকলেও চাকুরীর বাজারে নারীদের তেমন সাফল্য না পাওয়ার কারণ কি হতে পারে? শিক্ষা জীবনে নারীদের  ব্যাপক সাফল্যের মতো ক্যারিয়ার গঠনের দৌড়ে তাদের তেমন সফলতা দেখা যায় না কেন?  এর কারণ আসলে কি? কেউ কেউ বলে থাকে, ‘নারীর মাথায় বুদ্ধি কম; তাই তারা এক কেন্দ্রিক পড়ালেখায় ভালো করলেও চাকুরীর বাজারে টিকতে পারে না ।’ আবার কেউ বলেন বিয়ের কারণেই নারীরা ক্যারিয়ার গড়তে পারে না।  বিয়ে হলেই নারীদের দৌড় শেষ ! অনেকেই বলে থাকে “Marriage is the speed breaker of life .” 

কিন্তু কথাটা আসলে কতটা সত্য? আপাত দৃষ্টিতে ‘বিয়ে’ নারী-পুরুষ উভয়ের ক্যারিয়ার গঠনের ক্ষেত্রে অন্তরায় মনে হলেও আসলে মূল সমস্যা কিন্তু অন্য জায়গায় । ক্যারিয়ার গড়ার জন্য বিয়েকে প্রতিবন্ধক ভাবা হয় আমাদের স্থূল বুদ্ধির কারণে । বরং নারী পুরুষের দ্রুত বিয়ে হলে আমাদের সমাজে নৈতিক ও চারিত্রিক অবক্ষয় কিছুটা কমবে । জেনা-ব্যভিচার কমে যাবে অনেকাংশে ।  

একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখবেন যে বিয়ের পরেও কোনও কোনও নারী  বেশ ভালোভাবে ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে পেরেছে । এর কারণ কি? স্বামী ও তার পরিবারের সহযোগিতা কি তাকে  সামনে এগিয়ে দিয়েছে? যে নারী স্বামী ও পরিবারের সহায়তা এবং সমর্থন পায়, সে ক্যারিয়ার গড়তে পারে বেশ সুন্দরভাবে । আর যে পায় না সে অনেকাংশেই মুখ থুবড়ে পড়ে যায় হাজার মেধা ও প্রতিষ্ঠিত হবার অনেক স্বপ্ন থাকার পরও । পারিবারিক ও সামাজিক নানা ধরণের প্রতিবন্ধকতা মেয়েদের সামনে চলার পথকে কণ্টকাকীর্ণ করে তোলে । অবশ্য অদম্য ইচ্ছা শক্তির কারণে কোনও কোনও নারী শত প্রতিবন্ধকতার ভেতরও নিজের  স্বপ্নের ক্যারিয়ার গড়তে পারে । 

বিয়েকে ক্যারিয়ার গঠনে স্পিড ব্রেকার মনে করে আমাদের সমাজে ক্যারিয়ার গঠনের আগ পর্যন্ত ছেলেদের বিয়ে দেয়া না হলেও মেয়েদের কিন্তু বিয়ে না দিয়ে বসিয়ে রাখা হয় না । চাকুরী হোক না হোক, পড়া শেষ হোক না হোক মেয়েদের ঠিকই বিয়ে দিয়ে দেয়া হয় ।  এই দেশে পড়াশুনা শেষ করে ভাল মানের ক্যারিয়ার গড়তে গেলে একটা মেয়ের মোটামুটি ২৮-৩০ এর আগে বিয়ে দেয়া সম্ভব হয় না। আর আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে ৩০ পেরিয়ে যাওয়া মেয়েকে আয়ুবুড়ো ধাঁচের ধরা হয়ে থাকে। চেহারার লাবণ্য কমে যায়। তারুণ্যের মাঝে প্রানবন্ততা থাকে না। তাই চেহেরায় লাবণ্য ও উজ্জলতা থাকতেই বাবা-মা চায় তাকে বিয়ে দিয়ে দিতে । শিক্ষিত সমাজে অধিকাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় অনার্স বা মাস্টার্স চলাকালীন সময়ে । কম শিক্ষিত সমাজে মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায় কৈশোরেই ।

অন্যদিকে ছেলেদেরকে ক্যারিয়ার গড়ার আগে সাধারণত বিয়ে দেয়া হয় না । তার  উপর পারিবারিক একটা চাপ থাকে তাকে চাকুরী বা ব্যবসা করতে হবে; বিশেষ করে তাকে আয় করতেই হবে । আমাদের সমাজে ক্যারিয়ার গঠনের আগে বিয়ে করা পুরুষ মানুষের যেন হারাম! ভাল কোন চাকুরী বা ব্যবসা না করলে বিয়ের জন্য ভাল মেয়ে খুঁজে পাওয়া যায় না কোনও ছেলের জন্য । ভাল ক্যারিয়ার গঠনের জন্য ছেলেদের উপর সব সময় একটা পারিবারিক ও সামাজিক চাপ থাকে। বাবার অগাথ টাকা-পয়সা থাকলেও নিজে কোনও চাকুরী বা ব্যবসা করে না, এমন পুরুষ মানুষকে কেউ যেন ভালো চোখে দেখা না আমাদের সমাজে । নিজের উপার্জনের টাকায় সংসারের ব্যয়ভার বহন করতে হবে এমন একটা বাধ্যবাধকতা থাকে সকল পুরুষের উপর । 

নারীদের মতো আগে আগে বিয়ে না হওয়ায় তাদের উপর সংসারের কাজের চাপ এবং অতিরিক্ত দায়িত্ব থাকে না । পুরুষের কাছে পরিবারের প্রত্যাশা তুমি চাকুরী কর, ব্যবসা কর । মানে তার ক্যারিয়ার গঠন করাটাই তার জীবনের লক্ষ্য ও দায়িত্ব বানিয়ে দেয় পরিবারের এবং সমাজের মানুষগুলো । ক্যারিয়ার গঠনের ব্যাপারে পারিবারিক চাপ থাকলেও ক্যারিয়ার গঠনের জন্য পর্যাপ্ত সময় হাতে পায় তারা । তাই পরিবার ও সমাজের চাপ বা সহযোগিতা যাই বলেন না কেন একটা ছেলে নিজের ক্যারিয়ার গড়তে বাধ্য থাকে ।  

অন্যদিকে নারীর কাছে পরিবার ও সমাজের প্রত্যাশা তুমি আমাদের সময় দাও, আমাদের সেবা দাও; আমাদের বিপদ-আপদে আমাদের পাশে থাকো ছায়া হয়ে । পরিস্থিতি এমন যেন নারী পরিবারের সদস্যদের জন্য ক্যারিয়ার ছেড়ে দিতে বাধ্য! আর পুরুষ পরিবারের অন্যান্যদের জন্যই ক্যারিয়ার গড়তে বাধ্য ! 

আমি আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি বিয়ের পর মেয়েদের উপর সাংসারিক কাজের চাপ থাকে অনেক বেশি । বিবাহিত পুরুষের তুলনায় একজন বিবাহিত নারীর উপর অধিক মাত্রায়  দায়িত্ব চাপানো হয় । বাংলাদেশী নারীদের তো দিনে রান্না ও রান্না সংক্রান্ত কাজের পিছনেই গড়ে ৫-৬ ঘণ্টা ব্যয় করতে হয় । তার উপর আছে এ কাজ, ও কাজ, ... ।একটা মেয়ে বিয়ের আগে মায়ের সংসারে কাজ এড়িয়ে নিজের পড়ালেখা এবং চাকুরীর প্রস্তুতি নেবার জন্য যে সময় ও সুযোগ পায় সেই একই বয়সী মেয়ে কিন্তু শশুরবাড়ীতে সেই সুযোগ পায় না । শশুরবাড়ী বা স্বামীর ঘরে আসার পর এমন একটা অবস্থা তৈরি হয়ে যায় যেন ঐ নারীই ঐ সংসারের একমাত্র অবলম্বন । তাকে ছাড়া কোনও রান্নার কাজ হয় না, কারও খাওয়া হয় না । এমনকি ঘরদোর গোছানোর কাজও যেন চলে না তাকে ছাড়া! 

বিয়ের পর সংসারে কাজের বাড়তি  চাপ, পড়া শেষ হতে না হতেই অথবা চাকুরীর প্রস্তুতি নিতে না পারার আগেই  অনেক মেয়ে মা হয়ে যায় । মা হবার কারণে সন্তানের জন্য তার দায়িত্ব এবং কাজের চাপ আরও বাড়তে থাকে । সকালে ঘুম থেকে উঠে রাতে ঘুমাতে যাবার আগ পর্যন্ত একজন বিবাহিত নারীকে অনবরত খেঁটে যেতে হয় । স্বচ্ছল পরিবারে ছুটা কাজের বুয়া দুই একটা কাজ যেমন কাপড় কাঁচা ও ঘর মোছার কাজ করে দিয়ে গেলেও  নারীদের জন্য বাসায় কাজের শেষ থাকে না ।  এ বেলার খাবার বানানো, ও বেলার  চা-নাস্তা তৈরি, ফার্নিচার মোছা, সন্তান হয়ে থাকলে সন্তানের জন্য ফিডার তৈরি করা, সন্তানকে সময় দেয়া, তাকে ঘুম পাড়ানো ইত্যাদি নানা কাজ করতে করতেই বেচারির দিন শেষ । সারাদিন পরিশ্রম করার পর রাতে স্বামীকে সময় দেয়া, রোমান্টিক সময় কাটানো ...। এগুলো সারতে সারতে বেচারা শিক্ষিত গৃহিণী নারীর  সেই অর্থে আর গতানুগতিক ধারার ক্যারিয়ার গড়া হয়ে উঠে না  । শত কাজ করতে করতে নিজের জন্য আর ক্যারিয়ার গড়ার সময় থাকে না তাদের হাতে । এভাবেই সন্তান জন্মের পর সন্তানের নিরাপত্তা, সংসারের দেখভালের কথা চিন্তা করে নিজের স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দিতে হয় ভারতীয় উপমহাদেশের অধিকাংশ নারীকে।

আর এ কারণেই ছাত্রজীবনে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে অনেক বেশী মেধার স্বাক্ষর রাখতে পারলেও বিয়ের পর কিন্তু সেভাবে ছেলেদের মতো ক্যারিয়ার গড়ার প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে না । এর মাঝেও যারা ক্যারিয়ার গড়ে তোলে তাদের হয় অদম্য ইচ্ছা শক্তির কারণে, না হয় স্বামী ও শশুর বাড়ির মানুষের পূর্ণ সহায়তার জন্য ।

একদিন আমাদের অফিসে ঢাকা মেডিকেলের একজন প্রাক্তন ছাত্রী এসেছিলেন। শহিদ সোহরাওয়ার্দি মেডিকেলের একজন চিকিৎসক তিনি । আমার ননদের মেয়ে ঢাকা মেডিকেলে পড়ে ।  মেডিকেলে পড়া অনেক কঠিন এমন কথা প্রসঙ্গে তিনি বলে ফেললেন, “আমি এবং আমার মেয়ে বান্ধবীরা এফসিপিএস এবং এমডি করার সুযোগ পাচ্ছি না । ক্লাসের ফার্স্ট বেঞ্চে বসা ভালো ছাত্রী হওয়ার পরও আমাদের সুযোগ হচ্ছে না সন্তান ও পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে । মাঝে মাঝে খুব কষ্ট হয় এবং মনে হয় এমন কঠিন পেশায় কেন এলাম?  মেডিকেলে না পড়ে যদি এমন কোন বিষয়ে পড়তাম যাতে সহজ পেশা বেছে নেয়া যায়, তাহলে কতোই না ভাল হতো । সংসার ও পেশা দুইটা একসাথে চালাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে । অথচ আমাদের ক্লাসের ব্যাক বেঞ্চার ছেলে বন্ধুরা সবাই এফসিপিএস এবং এমডি করে ফেলেছে । পেশায় তারা অনেক ভাল করছে । ”

হিলারি ক্লিনটন তার বিখ্যাত আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ “লিভিং হিস্ট্রি” তে তার জীবনের একটা ঘটনা উল্লেখ করেন ।  সেই ঘটনা উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেন, “একবার এক বিখ্যাত আইনজীবী বার্ট জেনার এর সাথে কথপোকথনের সুযোগ হয় । কথা প্রসঙ্গে তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আমি কি করতে চাই ।’

উত্তরে আমি বললাম, ‘আমি তার মতো বিখ্যাত ট্রায়াল আইনজীবী হতে চাই ।’

 তিনি বললেন, ‘সেটা অসম্ভব ।’

 আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেন?’ 

‘কারণ তোমার তো বউ থাকবে না ।’

‘তার মানে? ’

বার্ট আমাকে বুঝিয়ে বললেন যে, কারও ঘরে যদি বউ না থাকে যাবতীয় কাজ দেখাশুনা করার, তাহলে সেই ব্যক্তির পক্ষে প্রতিদিনকার চাহিদা (যেমন কোর্টে প্রতিদিন পরিষ্কার মোজা পরে যাওয়া) মেটানো সম্ভব নয় । সেই থেকে আমি এখনও নিশ্চিত নই বার্ট  জেনার আমাকে  তামাশা করে কথা বলেছিলেন নাকি সত্যি মনে করেই বলেছিলেন যে, মেয়েদের জন্য এটা একটা ভীষণ কঠিন কাজ । ”

আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বান্ধবী ছিল । সে শুধু আমাদের ক্লাসেরই ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট  ছিল তা নয় । সে আমাদের পুরো অনুষদের সবচেয়ে ভালো ফলাফল অর্জনকারী এবং একজন গোল্ড মেডালিস্ট । অনার্স পড়াকালীন সময়ে তার বিয়ে হয়ে এক সরকারী ইঞ্জিনিয়ারের সাথে । বিয়ে  হলেও স্বামী দূরে থাকায় থেকেই পড়াশুনা করতো । কিন্ত  পড়াশুনা শেষে যখন স্বামীর কাছে চলে গেল তখন সে তার ছাত্র জীবনের সেই স্বর্নালী সময়টা আর ধরে রাখতে পারলো না । আল্লাহ চাইলে এমফিল বা পিএইচডি করলেই নিশ্চিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারতো সে । এমফিল শুরু করেছিল; কিন্তু সংসার ও সন্তানের দেখভালের দায়িত্বের কারণে মাঝপথেই এমফিল ত্যাগ করতে হয়েছিল । আশৈশব লালন করা স্বপ্নের বাস্তবায়নে তার আর অগ্রগামী হওয়া হয়নি । সন্তানের নিরাপত্তা, সংসার দেখভাল এবং স্বামীর চাওয়াটাকে সে প্রাধান্য দিয়ে সাচ্চা গৃহিণী হয়ে গিয়েছে । অথচ শিক্ষাজীবনে তার চেয়ে পিছিয়ে থাকা আমাদের ছেলে বন্ধু্দের কেউ এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কেউ বিসিএস ক্যাডার, কেউ পুলিশের বড় কর্মকর্তা, কেউ ব্যাংকের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা এবং  কেউ কেউ দেশে বিদেশে ভাল ভাল জায়গায় গবেষক ও হিসাবে চাকুরী করছে ।  

এখন কি আপনি বলবেন সে মেধাবী ছিল না? এক কেন্দ্রিক পড়া লেখা করে ক্লাসে এমনকি পুরো ফ্যাকাল্টিতে প্রথম হয়েছিল! না বরং সে সন্তান লালন-পালন, সংসারের দেখভাল এবং স্বামীর চাওয়াকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল বলে তথাকথিত ক্যারিয়ার গঠনে এগিয়ে যেতে পারেনি । স্বামীর চাওয়াকে উপেক্ষা না করে ক্যারিয়ার গঠনের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে নাই । নিজেকে দৈহিক ও  মানসিক চাপ থেকে  মুক্ত রেখে শুধুমাত্র গৃহিণীর পরিচয়েই বেঁচে থাকাটাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে হয়তো । নিজের চাওয়া-পাওয়াকে মাটি চাপা দিয়ে হৃদয়ের হাহাকার লুকিয়ে মাতৃত্বকে সে লালন করছে এবং এটা নিয়েই সে ভাল থাকার চেষ্টা করছে । সে তথাকথিত ক্যারিয়ার গঠনের প্রতিযোগিতায় আসেনি নিজের মেধা নাই বলে না, বরং স্বামী ও সন্তানের মুখ চেয়ে নিজের স্বপ্নের কোরবানি দিয়েছে ।  

আবার আমার হলের এক মেধাবী রুমমেট ও সিনিয়র আপু ছিলেন । যিনি মাদ্রাসা বোর্ডে দাখিল এবং আলিমে বোর্ড স্ট্যান্ড করেছিলেন এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকনোমিকসে মাস্টার্সে সেকেন্ড  হয়েছিলেন । অ্যাকাডেমিক লাইফে এতো সফল হবার পরও কেন তিনি তথাকথিত পেশাগত জীবনে সফল হতে পারেননি বলতে পারেন?  শুধুমাত্র সাংসারিক কাজের একক চাপ  ও দায়িত্বের কারণে এবং স্বামী ও পরিবারের সদস্যদের তার চাকুরী করার ব্যাপারে স্বদিচ্ছা এবং সহায়তা না থাকার কারণে নিজেকে তিনি মেলে ধরার চেষ্টা করেননি । গড়তে আসেননি স্বপ্নের তথাকথিত ক্যারিয়ার! এরকম হাজার হাজার মেয়ের কাহিনী আমরা জানি যারা চাকুরীর প্রতিযোগিতায় নামেননি বা নামলেও নিজেদের সেভাবে বিকশিত করতে পারেননি,  মেধা নাই বলে না । বরং পরিবারের কল্যাণের কথা চিন্তা করে ক্যারিয়ার গড়তে আসেন নাই বা ক্যারিয়ার গঠনের দৌড়ে পুরুষের সাথে সমানতালে সফল হওয়ার প্রতিযোগিতায় নামেন নাই । 

আবার এর ঠিক উল্টা রূপ আমরা দেখতে পাই কিছু কিছু নারীর জীবনে । যারা শিক্ষা জীবনে  সেরা না হলেও কিন্তু পেশাগত জীবনে ঠিকই অনেক ভাল করে ফেলছেন । আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগের ছোট বোন ইফফাত সকালের কথাই বলি । বিয়ের পর দুই সন্তানের মা হবার পরও ৩৮তম বিসিএসে সুপারিশপ্রাপ্ত হয় সে । বিসিএস গেজেট ঘোষণা হবার পর খুশীতে সে তার ফেসবুকের টাইমলাইনে পোস্ট দেয় নিম্নোক্ত ভাষায়-

“অবশেষে গেজেট হলো । ফাইনালি চাকরিতে জয়েন করতে যাচ্ছি । আসলে চাকরি করতেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই কিন্তু ওই যে পড়াশোনা করে চুপচাপ ঘরে বসে থাকবো এটা কেন যেন মেনে নিতে পারি না । অবশ্যই আমার এই পাওয়ার পেছনে আমার ফ্যামিলির সবার অবদান ছিল। কারণ দুইটা বাচ্চা নিয়ে পড়ালেখা করা এতটা সহজ কিছু না । মা-বাবা, শ্বশুর-শাশুড়ি, বোন সবাই সহযোগিতা করেছে । কিন্তু তারা একবার হলেও কখনও কখনও বলেছে দরকার কি বাদ দিয়ে দাও। আর হবে না । যে একটা মানুষ কখনও কোন অবস্থাতে আমাকে বলে নাই যে আমি পারব না, সেটা আমার হাজব্যান্ড। কারণ সে জানতো আমি কিছু না করে ঘরে বসে থাকলে মানসিকভাবে কতটা কষ্ট পাবো । এই মানুষটি সব সময় বলেছে অবশ্যই হবে। তুমি চেষ্টা করলেই পারবে । আমি পড়েছি, সে বেবিকে ঘুম পাড়িয়েছে । আমার জন্য রাত জেগেছে। কখনো বলেনি এটা করো, ওটা করো। বিয়ের পর হাজবেন্ডের সাহায্য ছাড়া আসলে যেকোনো কিছু করাই কঠিন।। সেটা যাই হোক । এই মানুষটা সব সময় আমাকে সব কিছুতে সাপোর্ট করে গিয়েছে...।”

২০২০ সালে আগস্ট মাসের ৯ তারিখে প্রথম আলোর নারীমঞ্চ পাতায় প্রকাশিত একটা প্রতিবেদনের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি আর একটা সুন্দর ও চমকপ্রদ ঘটনা । এটাও ঘটেছিল ৩৮ তম বিসিএস এর প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত ইয়াসমিন জান্নাতের জীবনে । জান্নাতের সংসারে কাজের চাপ কমিয়ে পড়াশুনা করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিলেন তার স্বামী আরিফুর রহমান । ইয়াসমিন জান্নাত বলেন- “ আমি যখন পড়ার টেবিলে তখন আমার স্বামী আরিফুর দক্ষ হাতে ধরেছে সংসারের হাল । আমাকে পড়ার টেবিলে নাস্তা দেওয়া, বাসায় অতিথি এলে সে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া, সব একা হাতে করেছে ।”

জান্নাত বলেন- “ঘরের চাপ মাথায় নিয়ে কার্যক্ষেত্রে সফল হওয়া কঠিন ।” জান্নাতের স্বামী বেসররকারী ব্যাংক কর্মকর্তা আরিফুর রহমান বলেন- “ছোটবেলায় মা মারা যাবার কারণে কাজ করে বড় হয়েছি । বিয়ের পরও ঘরের কাজগুলো করার চেষ্টা করি ।” পুরুষ হয়ে ঘরের কাজ করার কারণে অনেক সময় অনেকের নানা ধরণের তির্যক মন্তব্য শুনতে হয়েছে আরিফুরকে । তবে আরিফুরের মতে- “জান্নাত জয়ী হলে সেই জয় আমারও ।” 

আবার কয়েকদিন আগেও আমরা জেনেছি বগুড়ার গাবতলীর রিকশা চালক ফেরদৌস রিকশা চালিয়ে স্ত্রী সীমানুর খাতুনকে মাস্টার্স পাশ করিয়েছেন । টাকার অভাবে ফরম ফিলাপ করতে না পেরে ফেরদৌস নিজে এসএসসি পাশ করার সুযোগ না পেলেও রিকশা চালিয়ে সংসারের খরচ মিটিয়ে স্ত্রী সীমানুরকে উচ্চ শিক্ষিত করেছেন তিনি। সীমানুর খাতুন স্বামীর রিকশায় যাতায়াত করে এমএ পাশ করেছেন বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে । বর্তমানে বগুড়া কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজের প্রাথমিক শাখার সহকারী শিক্ষক হিসেবে আছেন রিকশাচালক ফেরদৌসের স্ত্রী সীমানুর । রিকশাচালক ফেরদৌস স্ত্রীর উচ্চ শিক্ষা অর্জন এবং সুন্দর ক্যারিয়ার গঠনের পথে বাঁধা না হয়ে বরং তাকে অনুপ্রেরণা দিয়ে, তার পড়ার ব্যয়ভার বহন করে তাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন অনেক দূর!

সীমানুর, সকাল ও জান্নাতের স্বামীর মতো এরকম স্বামী যদি সব মেয়ে পেতো তাহলে শিক্ষিত ও মেধাবী মেয়েদের ক্যারিয়ার গঠনের পথে কেউ দমাতে পারতো না । নিজেদের স্বপ্নের ক্যারিয়ার গড়তে সময় লাগতো না কারও । 

তবে মেয়েদের ক্ষেত্রে ক্যারিয়ার বলতে শুধু অর্থ উপার্জনের মাধ্যম একটা চাকুরী বা ব্যবসাকে বলা ঠিক হবে না ।  একটা মেয়েকে ক্যারিয়ার গড়তে হলে চাকুরী বা ব্যবসা করতেই হবে এমন ধারণা থেকে আমাদের বের হওয়া উচিৎ । কেউ যদি  “মাতৃত্ব”কে তার পেশা বা ক্যারিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেন তাহলে সেখান থেকে অর্থ উপার্জন হয় না বলে তাকে অসফল নারী বলার কোনও সুযোগ নেই । বরং তিনি পরিবার, সমাজ এবং একটা জাতির জন্য সবচেয়ে লাভজনক পেশায় নিয়োজিত আছেন  । যিনি মাতৃত্বকে অগ্রাধিকার দিয়ে গৃহিণী বা হোম মেকার হওয়াটা নিজের জীবনের পেশা বা ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছেন অর্থ উপার্জনের ভিত্তিতে তথাকথিত ক্যারিয়ারের মানদণ্ডে তাকে ছোট করে দেখার কোনও সুযোগ নেই । অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক গ্যারি বেকের কাতারের দোহায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে একটি বক্তব্য দেন। সেই বক্তব্যে তিনি বলেন, “বাচ্চাদের যত্ন ও প্রতিপালনের জন্য যে সকল নারী ঘরে থাকেন, তারা জাতীয় অর্থনীতিতে ২৫ % থেকে ৫০% হারে অংশগ্রহণ করেন । অথচ এই তথ্য অনেকেই জানে না । অনেকে মনে করে, যে সকল নারী ঘরের দায়িত্ব পালন করেন; তারা বেকার । তাদের দৃষ্টিতে, নারীগণ জাতীয় উৎপাদনের বোঝাস্বরূপ । অথচ আমরা দেখছি আন্তর্জাতিক অর্থনীতি তার বিপরীত সাক্ষ্য দিচ্ছে ।” 

সূত্রঃ  বইঃ মুমিন জীবনে পরিবার, লেখকঃ ইউসুফ আল কারজাভি

অবশেষে বলতে চাই যে, পেশা নির্বাচনের ক্ষেত্রে নারীর চাওয়া পাওয়ার মূল্যায়ন করা হোক । নারীকে ছোট করে দেখার এবং ছোট করে রাখার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাক । ‘মাতৃত্ব’ বা নারীর জন্য নিরাপদ অন্য কোনও পেশা যদি কোনও নারী বেছে নেয় পরিবারের সমঝোতার ভিত্তিতে তাহলে সেটা সাদরে গ্রহণ করা হোক। নারীর এই পেশা নির্বাচনটাকে সম্মান জানানো হোক । নারী বিয়ে এড়িয়ে নয় বরং বিয়ের পর স্বামী ও পরিবারের সহায়তায় এগিয়ে যাক তার স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে এই প্রত্যাশা করি সব সময় ।  “নারী” কবিতায় উল্লেখিত কাজী নজরুলের কয়েকটি পঙক্তি দিয়ে শেষ করতে চাই,  

“বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর

অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।

বিশ্বে যা কিছু এল পাপ তাপ বেদনা অশ্রুবারি,

অর্ধেক তার আনিয়াছে নর অর্ধেক তার নারী।”


লেখকঃ শারমিন আকতার

সম্পাদক, মহীয়সী এবং ব্যাংক কর্মকর্তা, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ